দেশে ভোক্তাপর্যায়ে এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। জারি হয়েছে প্রজ্ঞাপন। এবার যে কোনও মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ার ঘোষণা আসতে পারে। এরই মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেট্রোবাংলা ঘুরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত জুনে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের (এলএনজি) দাম বৃদ্ধির ধুয়া তুলে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ দাম বাড়িয়ে দেয় বিইআরসি। সার উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ২৫৯ শতাংশ, শিল্পে ১১.৯৬ শতাংশ, বিদ্যুতে ১২ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। আবাসিকে একচুলার দর ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৮০ টাকা করা হয়।
প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা, সার উৎপাদনে ঘনমিটার ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়। ওই দাম বাড়ানোর কিছুদিন পরেই স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিলে বেড়ে যায় গ্যাস সংকট, এতে শিল্প মালিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চান।
মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে তারা দাম বাড়িয়ে হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবি করেন। সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই গ্যাসের দাম বাড়াতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেট্রোবাংলা ঘুরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর খবর পাওয়া গেছে। যে কোনও দিন ঘোষণা আসতে পারে বলে নিশ্চিত করেছে সূত্র।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চান। তারা আন্তর্জাতিক বাজার দরে বিল দিতে আগ্রহে দেখিয়েছে। সরকার তাদের প্রস্তাবের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে। গ্যাস সরবরাহে শিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
২০২৫ সালে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবু ফারুক বলেছেন, পোস্ট সাবমিশনের জন্য ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। তারপর সিদ্ধান্ত দিতে চাই।
জানা যায়, গত রবিবার (৮ জানুয়ারি) বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গণশুনানি করেছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ওইদিন রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনের শহীদ এ কে এম শামসুল হক খান অডিটরিয়ামে ওই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে জানুয়ারির মধ্যেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল।
তবে সরকার চাইলে জনসাধারণের কথা বিবেচনায় যে কোনও সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে পারবে। সম্প্রতি এমন বিধান যুক্ত করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০২৩ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
বিষয়টি নিশ্চিত করে গত ৯ জানুয়ারি নবনিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, বিদ্যমান আইনানুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম ৯০ দিন সময় নিয়ে নির্ধারণ করে বিইআরসি। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকারও যেন তা নির্ধারণ করতে পারে এ জন্যই প্রস্তাবিত এই সংশোধনী মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে।
ইতোমধ্যেই এটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে অধ্যাদেশ আকারে জারিও করা হয়েছে। তবে ওই সময় জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলমান না থাকায় আইনে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে সংসদের অধিবেশন চালু রয়েছে। তাই নিয়মানুযায়ী সংসদে উত্থাপনের জন্য মন্ত্রিসভায় আইনটি অনুমোদন করে নেয়া হয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশে আবাসিক খাতের জ্বালানি ও শিল্প কারখানায় সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ২২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ২০২২ সালের ৪ জুন এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও একই বছরের পহেলা জুন থেকে নতুন মূল্য কার্যকর হয়। তখন ভোক্তা পর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ঘনমিটারে ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২.৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১.৯১ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়।
ঐ সময়ে নতুন মূল্যহার অনুযায়ী এক চুলার গ্যাসের জন্য মাসে ৯৯০ টাকা আর দুই চুলার জন্য নির্ধারণ হয় ১ হাজার ৮০ টাকা। তাছাড়া প্রিপেইড মিটারে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ টাকা, এটি আগে ছিল ১২.৬০ টাকা। আর সার কারখানায় সরবরাহ করা গ্যাসের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ১৬ টাকা। তবে সিএনজি গ্রাহকদের মূল্য হারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
বাংলাদেশে সর্বশেষ গ্যাসের মূল্য হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৯ সালে। তখন গ্যাসের পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ৭০ পয়সা। এ বছরের শুরুতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসির কাছে প্রস্তাব পাঠায় পেট্রোবাংলা। কিন্তু শুরুতে সেটা বিধিসম্মত হয়নি জানিয়ে ফেরত পাঠানো হয়।
পরে সংস্থাটি আবার প্রস্তাব পাঠায়। তখন গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কোম্পানিগুলো তখন বলেছিল, বাংলাদেশের গ্যাস ক্রমেই আমদানি করা এলএনজিনির্ভর হয়ে ওঠায় মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া বিকল্প নেই। এরপর ২১-২৪ মার্চ ওই প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি করে বিইআরসি।
গণশুনানি শেষে বিইআরসি জানিয়েছিল, পেট্রোবাংলার জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে প্রাপ্ত টাকা, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর মুনাফার টাকা এবং সরকারের প্রদেয় ভর্তুকির টাকা বিবেচনায় রেখে ভোক্তাপর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ঘনমিটারে ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২.৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১.৯১ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্রাহক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যবৃদ্ধির এই ঘোষণা দেন। একই বছরের ১ মার্চ থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির নতুন দাম কার্যকর হয়। বাড়তি দাম কার্যকর হয় দুই ধাপে।
সে অনুযায়ী, ১ মার্চ থেকে আবাসিক খাতে দুই চুলার জন্য ৮০০ এবং এক চুলার জন্য ৭৫০ টাকা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে জুন থেকে আবাসিক খাতে দুই চুলার জন্য ৯৫০ এবং এক চুলার জন্য ৯০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মার্চ থেকে প্রতি ঘনমিটার ১৪.২০ টাকা এবং জুনে ১৭.০৪ টাকা হবে। আর সিএনজির ক্ষেত্রে মার্চে প্রতি ঘনমিটার ৩৮ ও জুনে ৪০ টাকা করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১ মার্চ থেকে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটির গ্যাসের দাম ২ টাকা ৮২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ টাকা ৯৯ পয়সা। ক্যাপটিভ পাওয়ারের ক্ষেত্রে ৮ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৯৮ পয়সা করা হয়েছে।
বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ১১ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিল্প খাতে ৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ২৪ পয়সা করা হয়েছে। সিএনজিতে ৩৫ টাকা থেকে ৩৮ টাকা করা হয়েছে প্রথম ধাপে।
ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয় ধাপে বিদ্যুৎ খাতে ৩ টাকা ১৬ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ার ৯ টাকা ২২ পয়সা, শিল্প খাত ৭ টাকা ৭৬ পয়সা বাণিজ্যিক ১৭ টাকা ৪ পয়সা, সিএনজি ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩ এর ধারা ২২ (খ) ও ৩৪ এ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে কমিশন ভোক্তাপর্যায়ে গ্রাহক শ্রেণিভিত্তিক অভিন্ন মূল্যহার পুনঃনির্ধারণ করেছে, যা গড়ে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যা দুই ধাপে কার্যকর হবে।
নতুন ঘোষিত মূল্যবৃদ্ধির আগে আবাসিকে দুই চুলার জন্য ৬৫০ ও এক চুলার জন্য ৬০০ টাকা দিতে হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে বর্ধিত এই দাম কার্যকর করে বিইআরসি। আগে দুই চুলার জন্য ৪৫০ টাকা এবং এক চুলার জন্য ৪০০ টাকা দেয়া হতো।
যদিও আবারও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অবশ্য মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক। আবার কারও মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে দাম সমন্বয় করতে হবে। তবে সাধারণ ভোক্তাদের আশঙ্কা, বিদ্যুৎ, তেলের পর গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তা তাদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলবে।
২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস ফুরিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তখন পুরোপুরি আমদানি করা গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ গ্যাসের দাম পাঁচগুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।