ঢাকা, বৃহস্পতিবার - ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

প্রসূতির অস্ত্রোপচারের পর ‘ধাতব বস্তু রেখে’ সেলাই

ছবিঃ সংগৃহীত

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক প্রসূতির অস্ত্রোপচারের পর ‘ধাতব বস্তু রেখে’ সেলাই করে দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনার ২৮ দিন পর ওই ‘ধাতব বস্তু’ বের করতে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার এবং চিকিৎসায় অবহেলায় প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর স্বামী প্রণব দেব।

এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক ও উপপরিচালকের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। সুপর্ণার ১০ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। নবজাতক সুস্থ আছে।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শীলকূপ ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামের প্রণব দেবের স্ত্রী সুপর্ণা দেব (২৯)। প্রসব বেদনা শুরু হলে সুপর্ণাকে গত ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পরদিন রাত ২টা ১৫ মিনিটে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ছেলে সন্তান প্রসব করেন তিনি। ২ এপ্রিল মা-শিশুকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। বাড়ি ফিরে যায় মা-শিশু।

সুপর্ণার স্বামী প্রণব দেব জানান, ১৫ এপ্রিল থেকে সুপর্ণার পেটে ব্যথা অনুভূত হতে থাকে। গায়ে জ্বরও আসে। ১৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ ব্যথা চরম আকার ধারণ করলে তাঁকে চট্টগ্রামের বন্দর এলাকার এম এ আজিজ সড়কের সেইফল্যান্ড ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক শ্রাবণী বড়ুয়ার কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ডা. শ্রাবণী তাৎক্ষণিকভাবে রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার নির্দেশ দেন। রাত ১০টায় ওই ডায়াগনিস্ট সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। ওই পরীক্ষায় সুপর্ণার পেটে ‘১২.০৫ সে.মি. লম্বা ধাতব বস্তুর অস্তিত্ব’ ধরা পড়ায় চিকিৎসক দ্রুত রোগীকে পুনরায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি করার নির্দেশ দেন। জানালেন, তাঁকে জরুরিভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করতে হবে।

আরও পড়ুন  রাঙামাটিতে মাদ্রাসা ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে আটক শিক্ষক

প্রণব দেব বলেন, ‘পরের দিন ১৯ এপ্রিল সকাল ৮টায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই সুপর্ণাকে। তাকে হাসপাতালের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৫৪ নম্বর বেডে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর পর ওয়ার্ডে কর্তব্যরতরা আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ রোগীর চিকিৎসার সব কাগজপত্র আমার কাছ থেকে নিয়ে ফেলেন। তাঁরা রোগীর অবস্থা স্বাভাবিক নয় বললেও ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ফেলে রাখা হয়।’

বিষয়টি ওই দিন হাসপাতালের পরিচালক ও উপপরিচালক বরাবর লিখিতভাবে জানান সুপর্ণার স্বামী প্রণব। ‘অভিযোগের কথা শুনে ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও নার্সরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ২৫ এপ্রিল সকালে অপারেশন থিয়েটারে সুপর্ণাকে একবার ঢুকিয়ে আবার বের করে আনা হয়। পরে বিকেল ৫টায় তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়। ওই দিনগত রাত ১টা ১৫ মিনিটে হাসপাতালেই মারা যায় সুপর্ণা।’-যোগ করেন প্রণব দেব।

আরও পড়ুন  সাংবাদিকের মাকে গলা কেটে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা

সুপর্ণার স্বামী ও আত্মীয়-স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, অস্ত্রোপচারের সময় স্বামী বা স্বজনদের কারো কাছ থেকে কোনো দস্তখত নেওয়া হয়নি। কেড়ে নেওয়া আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার প্রতিবেদনটিও আর ফেরত পাননি তাঁরা। তাঁর মৃত্যুর সনদপত্রে লেখা হয়েছে, আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন সুপর্ণা। এছাড়া পেটে ইনফেকশনও ছিল।

নিহতের স্বামী প্রণব বলেন, ‘হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার প্রতিবেদন কেড়ে নেওয়ায় আবার সেই সেইফল্যান্ড ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে গিয়েছিলাম পরীক্ষার ডুপ্লিকেট কপি সংগ্রহ করতে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। আমার ধারণা, সেখানকার চিকিৎসক শ্রাবণী বড়ুয়া চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। হয়তো তিনি বারণ করেছেন প্রতিবেদনটি দিতে।’

ফোনে যোগাযোগ করা হলে সেইফল্যান্ড ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার থেকে রুবি পরিচয়দানকারী একজন বলেন, ‘সুপর্ণা যে পরীক্ষা করেছিলেন এর রেকর্ডপত্র আছে। কিন্তু পুনরায় পরীক্ষার প্রতিবেদন দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়বার দেওয়ার নিয়ম নেই।’

আরও পড়ুন  সদরঘাট অভয়মিত্র ঘাট থেকে নিখোঁজ স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার

জানতে চাইলে ডা. শ্রাবণী বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই নারীর অবস্থা খারাপ ছিল। তাই হাসপাতালে পুনরায় ভর্তি হতে বলেছিলাম। পরীক্ষায় রিপোর্টে ১২ সে.মি. লম্বা কিছু একটা দেখা গিয়েছিল বলে তাদেরকে জানিয়েছিলাম। তবে কোনো ধাতববস্তুর কথা বলিনি।’

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক মো. আক্তারুল ইসলাম রবিবার বিকেলে বলেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দেননি। প্রসূতির স্বামী অভিযোগ দিলে তদন্ত কমিটি গঠন করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জালাল উদ্দিন রবিবার বিকেলে বলেন, ‘ওই ঘটনা আমার জানা নেই। আপনার (প্রতিবেদক) মাধ্যমে প্রথম জানলাম। এটি তদন্ত করে দেখা হবে।’

নগরের বন্দর এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী প্রণব দেব বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। দিনে এনে দিনে খাই। কোর্ট-কাচারি, আইন-আদালত চিনি না। স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলাম। কোনো প্রতিকার পাইনি। স্ত্রীকে হারিয়ে নবজাতককে নিয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছি না। আমি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’

ট্যাগঃ